আজ অনেকেই বলবে যে, দর্শন আমাদের এই বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক জগতে একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সত্য থেকে আর চিরন্তন কিছুই হতে পারে না। যদি কিছু হয়, তবে আমাদের এখন আর দর্শন ছাড়া আর কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। আপনি যদি তা না মানেন তবে সেটা আপনার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, অন্য কারোর কিছু নয়।
আমরা বর্তমানে জ্ঞানের একটি ক্রমবর্ধমান সমুদ্রের মধ্যে বসে আছি। কিন্তু এই জ্ঞান কি পৃথিবীর সকল কিছু ব্যাখ্যা করে বা করতে প্রস্তুত? পৃথিবীর প্রতিটি জিনিস (হতে পারে তা দেখা যায় কিংবা দেখা যায় না) এর মাঝে একটি অন্তর্নিহিত আদেশ বা অর্থ আছে। এই অর্থ বোঝার জন্য কিংবা ব্যাখ্যার জন্য আমরা বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হয়। বিজ্ঞান সেই ব্যাখ্যা "কীভাবে প্রশ্নের" উত্তর খুঁজে বের করা যায় তার জন্য আমাদের দিক নির্দেশনা দেই। কিন্তু সেই ব্যাখ্যার "কেন প্রশ্নের" ব্যাখ্যা বের করতে বিজ্ঞান সক্ষম নয়। বিজ্ঞান যদি কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার একটি পদ্ধতি হয়ে থাকে তবে আমি বলবো এই পদ্ধতির অকার্যকর- এবং এই পদ্ধতিতে একটি ফাটল রয়েছে যা ধর্ম ঐতিহ্যগতভাবে সেই ফাটল পূরণ করে। কিন্তু যা একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক আবার প্রত্যাখ্যান করে। এই ফাটল পুরনের বিকল্প কি কোন কিছু আছে? দর্শন কি সেই ফাটল পুরন করতে পুরোপুরি সক্ষম? না, দর্শন ও সেই ফাটল পুরন করতে পুরোপুরি সক্ষম নয়। তবে দর্শন সেই ফাটলের মাঝে একটি নতুন সেতু নির্মাণ করে দেয়। যার কারনে সেই ফাটল অতিক্রম করতে আপনি পারবেন। বিজ্ঞান যন্ত্র সরবরাহ করে। আর দর্শন হল সেই যন্ত্রের সিম্ফনি।
অনেক মানুষ ঈশ্বর খোঁজার জন্য এবং ধর্মকে বোঝার জন্য ধর্মের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু সময় এখন যা তাহলো, ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ে আপনি আপনার মনের অনেক কিছুর পর্যান্ত উত্তর সরাসরি নাও পেতে পারেন আপনার জ্ঞানের অপ্রতুলতার কারনে। সেই সময় দর্শন আপনার সাহায্যকারী গাইড হিসেবে কাজ করবে। দর্শনশাস্ত্র আপনার ক্ষেত্রে আরও সাহায্যকারী গাইড হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে যেহেতু দর্শন নতুন জ্ঞান দ্বারা সংগঠিত হয় এবং ধর্মের ইতিহাস অতীতের শিক্ষাকে আরও সংযুক্ত করে। আমি মনে করি দর্শন দুটি প্রধান কারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ:
(১) দর্শন আপনাকে ক্রিটিকাল চিন্তাভাবনার জন্য দক্ষ করে তোলে এবং
(২) বিজ্ঞান যা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয় বা যার অস্তিত্ব কে অস্বীকার করে; দর্শন সেই সব জিনিসগুলোকে ব্যাখ্যা করে। বলতে পারেন, কি এমন জিনিস আছে যেটা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে অপারগ? হ্যাঁ, অবশ্যয় আছে এমন হাজার হাজার প্রশ্ন। যেমন ধরুন, সময় কি? যেমন ধরুন, আমাদের আত্মা কি?
দর্শনশাস্ত্রের গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে এমন অনেক লোক আছে যাদেরকে আমি চিনি খুব কাছ থেকে এবং ভালোভাবে। কিন্তু আমি সন্দেহ করি যে তারা মূলত দর্শনের জন্য যে পরিমান ক্রিটিকাল চিন্তার দরকার পড়ে, সেই পরিমান চিন্তা করতে তারা অপারগ বা বাংলা কথায় বলতে গেলে তারা পারে না বা বোঝে না কিভাবে যুক্তির পর যুক্তি বসিয়ে একটা সমস্যার সমাধান বের করে আনতে হয়। এর আরেকটি কারণ হতে পারে যে, তারা প্রথম থেকেই অনিশ্চিত বা ধরে নেই যে, দর্শনশাস্ত্র অগ্রগতি বা জ্ঞান প্রদান করতে পারে না।
যেমন ধরুন, আমরা ইতিহাস মোটেও পড়তে চায় না। আর কিছু কিছু ব্যক্তি যারা পড়ে তারা নেহাৎ পরীক্ষায় পাস অথবা চাকুরী পাবার আশায়। কোন কিছু শেখার আগ্রহ থেকে খুব কম মানুষজনই আছে যারা কিনা ইতিহাস পড়তে চাই। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশ এমনকি দেশের বাইরেও মানুষজন যখন কোন কিছু শেখার আগ্রহ প্রকাশ করে তখন কেবল তা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি তেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর তা যদিও না হয়ে কেউ কেউ অন্যকিছুর আগ্রহ প্রকাশ করে তবে তা তাদের চাকুরী কিংবা তাদের কর্মক্ষেত্রে সফলতার জন্যই তা তারা পড়ে থাকেন। কিন্তু এমন মানুষ খুব কমই আছেন যারা কিনা শুধুমাত্র নিজের কৌতূহল মেটানোর জন্য তাল তাল বই পড়ে চলেছে কিংবা এখনো পড়ছে। এরাই হচ্ছে প্রকৃত অর্থে দর্শনের অনুগত ছাত্র। আর অন্যদের কাছে ব্যাপারখানা এমন যেন প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান অথবা গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত সিলেবাসের বইতেই আছে দুনিয়াতে শেখার মতো সব কিছু। আর কিছু নাই। যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে একটু পরীক্ষা করা যাক।
যখন আপনি দশজন মানুষের সামনে রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন নিয়ে কথা বলবেন, আমি নিশ্চিত দশজনের ৭-৬ জনই সেই বিষয়ে আপনার সাথে আলোচনায় জড়িয়ে যাবে। অথচ তাদের কে প্রশ্ন করলে কারা তাদের সংজ্ঞাতো দূরে থাকুক, কেন সেই বিষয়টি আমাদের জানা উচিৎ তা বলতেও তারা অপারগ। যদি কেউ কেউ প্রশ্নের উত্তর দিতেও পারে, তবে যদি তাতে জিজ্ঞাসা করা হয় রেফারেন্সের কথা বা কোথায় দেখেছে বা শিখেছে, তাহলে দেখবেন সে কোন কথা বলবে না অথবা সে আলোচনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেন, সবাই চুপ থাকবে। সবাই বাহবা দিবে, অন্যদের কাছে আপনার গল্প ও করা হবে। আজকে কিন্তু পৃথিবীতে এই বিজ্ঞানই কিন্তু শুধুমাত্র টাকা পয়সা তৈরীর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
আর আমরা যারা বানিজ্য নিয়ে পড়াশোনা করি তাদের অবস্থা তো আরও করুন।
তারা একই সাথে টাকা কামিয়ে কোটিপতি হওয়ার ও যেমন স্বপ্ন দেখে আবার ইসলাম এবং কুরআন শরীফ কিংবা ধর্মীয় আদলেও জীবন টাকে গড়তে স্বচেষ্ট থাকে। অথচ, দুইটি যে এক সাথে কখনও সম্ভব নয় তারা তা ঘেটেও দেখে না আবার এই বিষয়ে চিন্তাও করতে পারে না, এমনকি জানেও না। তারা একই সাথে জ্ঞানী, কোটিপতি এবং ধর্মপরায়ন হওয়ার চেষ্টায় পৃথিবীটাকে দিনকে দিন হিংসা, বিদ্বেষ, ক্ষোভ, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এমনকি শুধুমাত্র নিজের কিংবা নিজের পরিবারবর্গের লোকজনদের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে অপরের ক্ষতি করে, তাদেরকে নিঃস্ব করে, পথের ভিখারীতে পরিনত করতে একটুও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। এমনকি এই ব্যাপারে তাদের কোন ধারনাও নাই। ধারনাটা হবেই বা কি করে? সকল শিক্ষার বা সকল বিদ্যার বা সকল পুস্তকের বাবা-মা হচ্ছে দর্শন। তারা সেই দর্শন কি সেটা জানা তো দূরে থাক উপরন্তু যারা এই দর্শন নিয়ে কথা বার্তা বলে বা মানুষদের যুক্তি দিয়ে নম্রভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে চাই তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি, অপমান এবং লাঞ্ছিত করতেও তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বৈশ্বিক অর্থনীতির কোন বিষয়টির ভূমিকা সবচেয়ে বেশী এবং তাদের পরিবর্তন এর সাথে রাজনীতিতে কি পরিবর্তন হচ্ছে, আমি নিশ্চিত ৮০% জনগন সঠিক উত্তর দিতে পারবে না।
কিন্তু তবুও তাদের আচার ব্যবহারে যে পরিমান অহংকার চোখে পড়ে, তাতে করে তাদের টাকার অহংকার ছাড়া আর কোনটিরই প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না।
এখানে আমাদের দেশের একটি গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
এদেশের অধিকাংশ মানুষ যারা একটু দর্শন চর্চা করে বলে মনে হয়, তাদের মধ্যে দেখা যায় অধিকাংশ লোকই ধর্ম বিদ্বেষী বা নাস্তিক প্রজাতির হয়ে থাকেন। আমি তাদের নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। কারন এটা তাদের নিজ নিজ জ্ঞানের অপ্রতুলতা কিংবা জ্ঞানের অতি উচ্চ পর্যায় ও হতে পারে। তারা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে যে, সক্রেটিস এর ছাত্র ছিল প্লেটো এবং প্লেটোর ছাত্র ছিল অ্যারিস্টটল। আর অ্যারিস্টটল যে বিষয়ে কথা কিংবা আলোচনা কিংবা চিন্তা করে নাই সেই বিষয়ে আমাদের ভাবারও প্রয়োজন নাই কারন তিনি এমন কোন বিষয় নাই যে বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন নাই। আর এই আঅ্যারিস্টটল এর গুরু প্লেটো: সক্রেটিস এর আচার ব্যাবহার আর "জ্ঞান" এর এতই বেশী প্রেমে পড়েছিলেন যে, তিনি তার পুরো ৮৪ বছরের জীবনে তার গুরুর গুণকীর্তন আর তার গুরুর দেখানো পথেই হেঁটে গেছেন। এখানে বলা বাহুল্য যে, তৎকালীন এথেন্স নগরীতে হাজার রকমের দেব-দেবীর পূজা চলত। কিন্তু তখনকার এথেন্স নগরীতে সক্রেটিস বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন; যিনি ছিলেন এক ঈশ্বর বাদীতে বিশ্বাসী। প্রমান স্বরূপ, আপনারা প্লেটো এর লিখিত "অ্যাপোলজি" কিংবা "সক্রেটিসের জবানবন্দি" গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে, আমাদের দেশে দর্শন চর্চাটা এখনো সেরকম ভাবে শুরুই হয়নি বলা চলে।
এবার আরেকটি অন্য বিষয় আপনাদের মাঝে প্রস্তাব করছি। ধরুন, আমরা মানে মানুষ জ্ঞাতি পৃথিবীতে এসে বুদ্ধি জ্ঞান হওয়ার পর যদি দেখি যে আমার কোন মা বাবা নাই। তাহলে আমাদের কেমন লাগবে? আমাদের জীবদ্দশায় কে আমাদের পিতা-মাতা এবং তাদেরকে খুজে বের করায় আমাদের প্রধানতম ব্রত হওয়া উচিৎ নয়?
ব্যাপারটা আসলে এরকমই। এই যে শিক্ষা। যা আমরা অর্জন করছি তার অস্তিত্ত্ব আসলে কোথায়? কোথা হতে শিক্ষার এই উদ্ভব? তা কি আমাদের জানা উচিৎ নয়? কিংবা কখনো কি আমাদের মনে এই প্রশ্ন জেগেছে?