ইন্দোনেশিয়ার রাস্তায় গত সপ্তাহ থেকে যে উত্তাল আন্দোলনের জন্ম হয়েছে, তা কেবল একটি ক্ষণস্থায়ী সামাজিক অস্থিরতা নয়, বরং দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিফলন। অন্তত সাতজনের মৃত্যু, শত শত আহত, সরকারি ভবন ও সংসদ সদস্যদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, পরিবহন অবকাঠামো ভাঙচুর—সবকিছুই প্রমাণ করে দেশটি এক অভূতপূর্ব সংকটে দাঁড়িয়ে আছে। প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো, যিনি মাত্র এক বছর আগে ক্ষমতায় এসেছেন, এখন তার শাসনের প্রথম বড় পরীক্ষার মুখোমুখি।
এই বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল ২৫ আগস্ট, ২০২৫-এ। রাজধানী জাকার্তার সংসদ ভবনের সামনে হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছিলেন একটি নির্দিষ্ট দাবিতে: সংসদ সদস্যদের আবাসন ভাতা, যা ন্যূনতম মজুরির প্রায় দশ গুণ, তা বাতিল করতে হবে। সাধারণ মানুষের জন্য এটি ছিল একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, কারণ এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও কঠোর কৃচ্ছ্রনীতি বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, সরকারি অবকাঠামো প্রকল্প সীমিত করা হয়েছে, অথচ অভিজাত রাজনীতিকদের জন্য বিলাসবহুল ভাতা চালু রাখা হয়েছে। এটি যেন জনগণের সঙ্গে অভিজাত শ্রেণির ফাঁরাকের একটি স্পষ্ট প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
ছাত্র সংগঠন গেজায়ান মেমাঙ্গগিল এক বিবৃতিতে বলেছিল, এই পদক্ষেপ আসলে সরকারের ভেতরে গেঁথে থাকা দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের স্বার্থ রক্ষা করছে। তাদের ভাষায়, সরকারের নীতি এমনভাবে তৈরি হচ্ছে যাতে লাভবান হয় বড় বড় কংগ্লোমারেট ও সামরিক অভিজাতরা, অথচ সাধারণ মানুষ জীবনযুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে। এই বিবৃতির ভেতরে প্রাবোওর শাসন নিয়ে একটি মৌলিক সমালোচনা লুকিয়ে ছিল; তার শাসনে সেনাবাহিনীর প্রভাব আবারও বাড়ছে। ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে সেনাবাহিনীর আধিপত্যের প্রভাব এতটাই প্রবল যে, জনগণ সবসময়ই আশঙ্কা করে থাকে গণতান্ত্রিক শাসন কি আবার পিছিয়ে যাবে না।
প্রথমদিকে এই আন্দোলন ছিল মূলত ছাত্র ও শ্রমিকদের। কিন্তু ২৯ আগস্ট এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। রাজধানী জাকার্তার বিক্ষোভ চলাকালে একটি সাঁজোয়া পুলিশি গাড়ি ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং ২১ বছর বয়সী এক ডেলিভারি ড্রাইভারকে চাপা দিয়ে হত্যা করে। এই দৃশ্য ভিডিওতে ধরা পড়ে এবং মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। যা শুরু হয়েছিল সীমিত পরিসরে, তা মুহূর্তেই দেশব্যাপী আন্দোলনে রূপ নেয়।
এরপর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বান্দুং, যোগিয়াকার্তা, সলো, মাকাসার, পলেম্বাং, বানজারমাসিন ও গোরোন্তালোতে। বিভিন্ন শহরে সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ হয়, পুলিশ সদর দফতর লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হয়। মাকাসারে তিনজন মানুষ পুড়ে মারা যান একটি কাউন্সিল ভবনে আগুন লাগার পর। একই শহরে আরেকজনকে ভুলবশত গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভেবে জনতা পিটিয়ে হত্যা করে। যোগিয়াকার্তায় একজন ছাত্র পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারান। সলো শহরে এক ষাটোর্ধ্ব রিকশাচালক কাঁদানে গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
অর্থমন্ত্রী শ্রী মুলিয়ানি ইন্দ্রাওয়াতীর বাড়িতেও হামলা হয় এবং লুটপাট চালানো হয়। একাধিক সাংসদের বাড়ি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। জাকার্তার গভর্নর প্রামোনো অনুং জানিয়েছেন, শুধু রাজধানীতেই পাঁচ দিনে আটক করা হয়েছে ১,২৪০ জনেরও বেশি মানুষ। সরকারি হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫ বিলিয়ন রুপিয়া, যা প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই অবস্থায় প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো ঘোষণা দেন যে তিনি পরিকল্পিত বিদেশ সফর বাতিল করছেন। তিনি চীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কুচকাওয়াজে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য দেশে থেকে যান। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল কঠোর: তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভ দমন করার নির্দেশ দেন। তার ভাষায়, "এখানে অবৈধ কর্মকাণ্ড, রাষ্ট্রদ্রোহ এমনকি সন্ত্রাসবাদের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তাই পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে আমি সর্বোচ্চ আইনানুগ কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেছি।"
<img src ='https://cms.thepapyrusbd.com/public/storage/inside-article-image/pww3smx3a.jpg'>
তবে তিনি পুরোপুরি অনমনীয় ছিলেন না। কিছু ছাড় দিয়েছেনও। সংসদ সদস্যদের ভাতা কমানোর ঘোষণা দেন, বিদেশ সফরের সুবিধা সীমিত করার আশ্বাস দেন। নিহত ডেলিভারি ড্রাইভারের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সংশ্লিষ্ট সাত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বচ্ছ তদন্তের নির্দেশ দেন। তবে একই সঙ্গে তিনি আহত পুলিশ সদস্যদের পরিদর্শন করতে যান এবং তাদের মধ্যে ৪০ জনকে পদোন্নতি দেন, যেন নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল অক্ষুণ্ণ থাকে। এই দ্বৈত কৌশল থেকে বোঝা যায় প্রাবোও একই সঙ্গে জনমত শান্ত রাখতে চাইছেন, আবার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ শক্ত করতেও সচেষ্ট।
কিন্তু এই সংকট আসলে হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। এটি ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের গভীর শিকড় থেকে উঠে এসেছে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দেশটি শাসন করেছিলেন জেনারেল সুহার্তো। প্রায় ৩২ বছরের এই সামরিক শাসনে ইন্দোনেশিয়া একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখলেও রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল অত্যন্ত সীমিত। বিরোধীদল দমন, দুর্নীতি, সেনাবাহিনীর সর্বময় প্রভাব—এসবই ছিল তার শাসনের বৈশিষ্ট্য।
১৯৯৮ সালে এশিয়ান অর্থনৈতিক সংকটের সময় তীব্র মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা রাস্তায় নামে, শ্রমিকদের অসন্তোষও বিস্ফোরিত হয়। হাজারো প্রাণহানির পর সুহার্তো ক্ষমতাচ্যুত হন। ইন্দোনেশিয়া তখন গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে, যাকে বলা হয় সংস্কার যুগ।
এই সংস্কার যুগেই প্রাবোও সুবিয়ান্তোর নাম আলোচনায় আসে ভিন্নভাবে। তিনি তখন সেনাবাহিনীর এক প্রভাবশালী জেনারেল এবং সুহার্তোর জামাতা। অভিযোগ ওঠে যে তিনি ছাত্র আন্দোলনের সময় কর্মী অপহরণ ও গুমে জড়িত ছিলেন। যদিও তার বিরুদ্ধে সরাসরি আদালতে দণ্ড হয়নি, সেনাবাহিনী তাকে অব্যাহতি দেয় এবং বিদেশ ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাকে এখনো দায়ী করে। অথচ সেই প্রাবোও-ই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করে এক সময় প্রেসিডেন্ট হন। এই ঘটনাটিই ইঙ্গিত দেয় ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জটিলতাকে।
আজকের বিক্ষোভে তাই শুধু সংসদীয় ভাতা নয়, বরং আরও গভীর ক্ষোভ কাজ করছে। জনগণ আশঙ্কা করছে যে ইন্দোনেশিয়া আবারও সেনা-প্রভাবিত কর্তৃত্ববাদী শাসনে ফিরে যাচ্ছে। প্রাবোওর অতীত, সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান ভূমিকা এবং অভিজাতদের সুবিধাবাদী নীতি—সবকিছু মিলেই মানুষের মনে এই ভয় জাগিয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও পরিস্থিতি জটিল। ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি হলেও জনগণের একটি বড় অংশ এখনো দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি বাস করছে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সংকট এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বাজেট কাটছাঁট—এসব সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়েছে। সংসদ সদস্যদের বিলাসবহুল ভাতা তাই একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে—এটি জনগণ ও অভিজাত শ্রেণির মধ্যে তীব্র বৈষম্যের প্রতিফলন।
আন্তর্জাতিকভাবে এ ঘটনায় নানান প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। তারা একটি স্বচ্ছ তদন্তের দাবি করেছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরকারকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে অভিযুক্ত করেছে এবং বলেছে, জনগণের ন্যায্য প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহ বা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তুলনা করে সরকার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। তাদের এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি উল্লেখ করেছেন, ইন্দোনেশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগের, আর এই ঘটনা সেই ইতিহাসকেই পুনরাবৃত্তি করেছে।
<img src ='https://cms.thepapyrusbd.com/public/storage/inside-article-image/3aizaei9z.jpg'>
বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও তাদের নাগরিকদের সতর্ক করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, কানাডা এবং আরও কয়েকটি দেশ স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়ায় তাদের নাগরিকরা যেন বড় জনসমাবেশ বা বিক্ষোভের এলাকায় না যান। এ ধরনের সতর্কতা আন্তর্জাতিক মহলে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ইন্দোনেশিয়ার অস্থিরতা কেবল অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং কূটনৈতিক সম্পর্ক, বিদেশি বিনিয়োগ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও একটি হুমকি।
প্রাবোও এখন দ্বিধার মধ্যে রয়েছেন। তিনি যদি আরও কঠোরভাবে দমন চালান, তাহলে প্রাণহানি বাড়বে, আন্তর্জাতিক চাপও তীব্র হবে। অন্যদিকে, তিনি যদি ছাড় দেন, তবে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে তার নেতৃত্ব দুর্বল বলে বিবেচিত হতে পারে। ফলে তার সামনে এক জটিল ভারসাম্যের খেলা: একদিকে জনগণের দাবির প্রতি সাড়া দেওয়া, অন্যদিকে সামরিক প্রতিষ্ঠানের আস্থা ধরে রাখা।
আজকের ইন্দোনেশিয়ার বিক্ষোভ কেবল একটি ভাতার বিরুদ্ধে নয়। এটি আসলে সেই মৌলিক প্রশ্নের প্রতিধ্বনি—১৯৯৮ সালের সংস্কারের পর যে গণতন্ত্র গড়ে উঠেছে, তা কি টিকবে, নাকি দেশ আবারও অতীতে ফিরে যাবে? জনগণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। প্রাবোওর শাসনের শুরুতেই এই প্রশ্ন ওঠা তার জন্য বড় সংকেত। ইতিহাস যদি কিছু শেখায়, তবে তা হলো—ইন্দোনেশিয়ার মানুষ বারবার কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এবারও তারা একই পথেই হাঁটছে।
ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যৎ : বিক্ষোভ-পরবর্তী অনিশ্চয়তার পথচলা
ইন্দোনেশিয়ায় সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও সহিংসতা দেশটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো ক্ষমতায় আসার পর মাত্র এক বছরের মধ্যেই যেভাবে দেশজুড়ে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হলো, তা কেবল একটি তাৎক্ষণিক সংকট নয়, বরং ইঙ্গিত দেয় দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার। জনগণের ক্ষোভ, নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণ, সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং বৈশ্বিক পরিসরে ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান—সবকিছু মিলে ভবিষ্যতের গতিপথকে কঠিন ও অস্বচ্ছ করে তুলেছে।
রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া আবারও কি কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকবে, নাকি গণতন্ত্রের যে ভিত্তি ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের পর গড়ে উঠেছিল, তা কোনোভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে? প্রাবোওর অতীত সেনা-পটভূমি এবং তার সাম্প্রতিক কঠোর অবস্থান এই শঙ্কা জোরদার করেছে যে, দেশটি হয়তো ধীরে ধীরে সামরিকতন্ত্রের দিকে ফিরে যেতে পারে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যু ও অমানবিক দমননীতি ইতিমধ্যেই জনগণের মনে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা নষ্ট করছে। এর ফলে ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক আন্দোলন কিংবা রাজনৈতিক ভাঙন দেখা দিতে পারে। যদি সরকার কেবল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলাতে চায়, তবে তা সাময়িক স্থিতিশীলতা আনলেও দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রীয় বৈধতা দুর্বল হয়ে পড়বে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও চ্যালেঞ্জ আরও গভীর। বিক্ষোভের অন্যতম কারণ ছিল কৃচ্ছ্রনীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কাটছাঁট এবং সংসদ সদস্যদের বিলাসবহুল ভাতা। যদি সরকার এই নীতি বজায় রাখে, তবে দারিদ্র্য ও বৈষম্য আরও বাড়বে, যা সামাজিক অস্থিরতাকে দীর্ঘায়িত করবে। ইতিমধ্যেই রাজধানী জাকার্তায় অবকাঠামো ধ্বংস, ব্যবসায়িক স্থবিরতা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ দেশটির অর্থনীতিকে নাজুক করে তুলেছে। ভবিষ্যতে যদি বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায় এবং পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়বে। তাই সরকারের সামনে একটি দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়েছে—একদিকে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা, অন্যদিকে জনঅসন্তোষ প্রশমিত করা।
সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ আরও জটিল। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী শ্রেণি, এই বিক্ষোভের মূল চালিকাশক্তি। তাদের হতাশা যদি দীর্ঘমেয়াদে সমাধান না হয়, তবে নতুন এক প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে আরও র্যাডিক্যাল হয়ে উঠতে পারে। ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্যের দেশ ইন্দোনেশিয়ায় অস্থিরতা যদি বাড়তে থাকে, তবে তা সহজেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় রূপ নিতে পারে। এই ঝুঁকিকে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ভাঙন বা আঞ্চলিক বিদ্রোহের আশঙ্কা অস্বীকার করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যৎ সমানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই তদন্ত দাবি করেছে এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরকারের সমালোচনা করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নাগরিকদের সতর্ক করেছে, যা বিনিয়োগ ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যদি পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তবে ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ান (ASEAN)-এও চাপের মুখে পড়তে পারে। আবার চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বৃহৎ শক্তিগুলো ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় সরাসরি স্বার্থ রাখে। তাই ভবিষ্যতে দেশটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রতিযোগিতার এক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—প্রাবোও সরকার কি এই সংকটকে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান করতে চাইবে, নাকি বলপ্রয়োগকে প্রধান হাতিয়ার করবে? যদি সরকার সত্যিকার অর্থে সংস্কারমুখী হয়, তবে সংসদীয় ভাতা কমানো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পুনঃবিনিয়োগ, বেকারত্ব হ্রাস এবং সেনাবাহিনীর প্রভাব সীমিত করা—এসব পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বিক্ষোভ আরও ঘনীভূত হবে এবং দেশটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার এক দীর্ঘমেয়াদি চক্রে প্রবেশ করবে।
সুতরাং ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যৎ এখন এক সঙ্কটময় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে প্রতিটি সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে দেশটি গণতন্ত্র ও জনঅংশগ্রহণের পথে অগ্রসর হবে কিনা, নাকি আবারও কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির অন্ধকারে ফিরে যাবে। জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত না হলে, অর্থনীতি পুনর্গঠিত না হলে এবং আন্তর্জাতিক আস্থা পুনরুদ্ধার না হলে ইন্দোনেশিয়ার জন্য সামনে অপেক্ষা করছে অস্থিরতা, বিভাজন ও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
Comments