২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতি হঠাৎই অস্থির হয়ে ওঠে, যখন একাধিক রাশিয়ান ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। পোল্যান্ডের সামরিক বাহিনী জানায়, এক রাতের মধ্যে প্রায় উনিশ থেকে তেইশটি ড্রোন সীমান্ত অতিক্রম করে, যাদের মধ্যে কয়েকটি গুলি করে ভূপাতিত করা হলেও বেশ কয়েকটি অনায়াসে তাদের আকাশসীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে ন্যাটোর মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং পোল্যান্ড বাধ্য হয় ন্যাটোর ধারা ৪ কার্যকর করে জরুরি পরামর্শ সভার ডাক দিতে। এটি শুধু একটি সামরিক অনুপ্রবেশ নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতির ওপরও এক গভীর ছায়া ফেলেছে, কারণ এটি স্পষ্টতই রাশিয়ার একটি উদ্দেশ্যমূলক সংকেত, যা ইউরোপীয় নিরাপত্তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
রাশিয়ার দৃষ্টিতে এ ধরনের ড্রোন অনুপ্রবেশ নিছক একটি কাকতালীয় ঘটনা নয়। বরং এটি তাদের কৌশলগত পরীক্ষার অংশ হতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করার পর মস্কো জানে, ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না, তবে ছোটখাটো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তারা কতটা কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে সেটাই পরীক্ষা করা হচ্ছে। ড্রোন নামক অস্ত্রের প্রকৃতি এমন, যা সহজে অস্বীকার করা যায়। রাশিয়া ইতোমধ্যেই দাবি করেছে যে এসব অভিযোগ “পুরোনো নাটক”, নতুন কিছু নয়। এতে বোঝা যায়, তারা ঘটনাটিকে হালকা করে দেখাতে চাইছে, যেন ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়া সীমিত থাকে। কিন্তু বাস্তবে এটি অনেক বড় বার্তা বহন করছে।
ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটি নিছক সীমান্ত লঙ্ঘন নয়; বরং এটি সার্বভৌমত্বের সরাসরি চ্যালেঞ্জ। আকাশসীমা একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতীক, এবং এর লঙ্ঘন মানে রাষ্ট্রটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেখানো। ন্যাটো সদস্য হিসেবে পোল্যান্ড জানে, এমন অনুপ্রবেশ যদি অব্যাহত থাকে এবং তাতে যথাযথ প্রতিক্রিয়া না দেওয়া হয়, তবে রাশিয়া আরও সাহসী হয়ে উঠতে পারে। এটি শুধু পোল্যান্ড নয়, বরং লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া কিংবা রোমানিয়ার মতো দেশগুলোকেও শঙ্কিত করছে, কারণ ইউক্রেনের সীমান্তজুড়ে এ ধরনের “গ্রে-জোন” কৌশল চলতেই পারে।
রাশিয়ার সম্ভাব্য উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো ন্যাটোর সামরিক প্রতিক্রিয়ার সময় ও সক্ষমতা যাচাই করা। ড্রোন আক্রমণ বা অনুপ্রবেশের সময় কত দ্রুত সতর্ক সংকেত বাজে, কত দ্রুত যুদ্ধবিমান উড়ে যায়, কিংবা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়—এসবই মস্কোর কাছে অমূল্য তথ্য। তাছাড়া, এর মাধ্যমে তারা জনমনে ভয় সৃষ্টি করতে পারে এবং পশ্চিমা জনমতকে চাপে ফেলতে পারে। ইউরোপের নাগরিকরা যদি অনুভব করেন যে যুদ্ধ তাদের দুয়ার পর্যন্ত চলে এসেছে, তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আরও রক্ষণশীল বা সতর্ক নীতি নিতে চাপ দেওয়া সম্ভব। রাশিয়া বহুদিন ধরেই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকে তাদের সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে।
<img src ='https://cms.thepapyrusbd.com/public/storage/inside-article-image/diljrrlz4.jpg'>
Picture Collected from cfr.org
অন্যদিকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটি একটি রাজনৈতিক পরীক্ষা। ন্যাটোর ধারা ৪ মানে সদস্য দেশগুলো পরামর্শে বসবে, কিন্তু এর মানে সরাসরি প্রতিশোধমূলক সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া নয়। তবুও, এর মাধ্যমে সংকেত দেওয়া হয়েছে যে আকাশসীমার নিরাপত্তা অগ্রাহ্য করা হবে না। সমস্যা হলো, ন্যাটোর অভ্যন্তরে সব দেশ সমানভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে চায় না। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো কঠোর প্রতিক্রিয়া দাবি করছে, কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র এখনো আশঙ্কা করছে যে অতিরিক্ত শক্তি প্রদর্শন করলে সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত বেধে যেতে পারে। ফলে ন্যাটোর ঐক্য এখানে বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে।
পোল্যান্ড ইতোমধ্যেই সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন এয়ার-ডিফেন্স জোন ঘোষণা করেছে। রাতের সময়ে বেসামরিক বিমান চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এটি কেবল নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং প্রতীকীভাবেও বার্তা দেয় যে আকাশসীমা সুরক্ষার জন্য তারা প্রস্তুত। কিন্তু এর ফলে বেসামরিক বিমান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, অর্থনৈতিক খরচ বাড়ছে, এবং ইউরোপের আকাশপথ নিয়ে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। বিমান সংস্থাগুলোকে নতুন রুটে যেতে হচ্ছে, যা খরচ বাড়াচ্ছে এবং যাত্রীদের জন্য অস্বস্তি তৈরি করছে। এই অর্থনৈতিক চাপও ইউরোপীয় নেতৃত্বকে ভাবিয়ে তুলছে।
রাশিয়ার জন্যও এই ঘটনায় ঝুঁকি রয়েছে। একদিকে তারা হয়তো কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে—ন্যাটোর প্রতিক্রিয়ার সীমা যাচাই করছে, ইউরোপে ভয় সৃষ্টি করছে। কিন্তু অন্যদিকে তারা ইউরোপীয় সংহতিকে আরও মজবুত করার ঝুঁকিও নিচ্ছে। ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জোর দিয়ে বলেছেন, ইউরোপের উচিত আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে আলোচনাও শুরু হয়েছে যে, ড্রোন প্রযুক্তির সরবরাহ চেইন কোথা থেকে আসছে, কারা রাশিয়াকে সহায়তা দিচ্ছে, এবং কিভাবে সেটি বন্ধ করা যায়। অর্থাৎ, রাশিয়া যতবার সীমা লঙ্ঘন করছে, ততবার ইউরোপ আরও সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার কারণ পাচ্ছে।
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক আইনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশসীমা লঙ্ঘন জাতিসংঘ সনদের মৌলিক নীতিকে ভঙ্গ করে—সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান। পোল্যান্ড ইতোমধ্যেই জাতিসংঘে জরুরি বৈঠকের দাবি করেছে। যদিও নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতার কারণে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন, তবুও কূটনৈতিকভাবে ঘটনাটি নথিভুক্ত করা এবং বিশ্বজনমতকে সক্রিয় করা ইউরোপের একটি বড় হাতিয়ার। এর মাধ্যমে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও কোণঠাসা করার চেষ্টা চলবে।
ঘটনাটি প্রযুক্তিগত দিক থেকেও চিন্তার। ড্রোন এখন আর শুধু বড় রাষ্ট্রের অস্ত্র নয়, বরং এটি সস্তা, সহজলভ্য এবং বহুমুখী। ইউক্রেন যুদ্ধেই দেখা গেছে কিভাবে শত শত সস্তা ড্রোন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই ইউরোপের প্রতিরক্ষা কৌশলকে দ্রুত বদলাতে হবে। শুধু প্রচলিত বিমান প্রতিরক্ষা নয়, বরং ড্রোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক জ্যামিং, উন্নত রাডার প্রযুক্তি—সবকিছুতেই নতুন বিনিয়োগ জরুরি। নইলে এ ধরনের অনুপ্রবেশ আরও ঘন ঘন ঘটবে।
দীর্ঘমেয়াদে এ ঘটনা ইউরোপীয় রাজনীতিতে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে। সাধারণ নাগরিকরা যদি মনে করেন তাদের আকাশ আর নিরাপদ নয়, তবে সরকারগুলোকে প্রতিরক্ষা খাতে আরও অর্থ ব্যয় করতে হবে। ইতোমধ্যেই পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ন্যাটো বাজেট বাড়ানোর দাবি তুলেছে। পশ্চিম ইউরোপেও ধীরে ধীরে জনমত শক্ত হচ্ছে যে, কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। ফলে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা একীকরণের পথ আরও জোরালো হবে।
তবে সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ভুল বোঝাবুঝি বা ভুল প্রতিক্রিয়া। ধরুন, একটি ড্রোন ভুলক্রমে বেসামরিক ভবনে আঘাত করল এবং হতাহতের ঘটনা ঘটল, তখন ইউরোপীয় জনমনে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবে। সরকারগুলো তখন আরও আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে। এভাবেই ছোট একটি ড্রোন থেকে বড় যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই ইউরোপকে এখন দ্বৈত কৌশল নিতে হবে—একদিকে শক্ত অবস্থান দেখানো, অন্যদিকে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া এড়ানো।
রাশিয়ার কৌশল মূলত “ধূসর অঞ্চল” (Grey Zone) তৈরি করা—যেখানে যুদ্ধ আর শান্তির সীমানা মুছে যায়। এটি তাদের জন্য সুবিধাজনক, কারণ তারা প্রতিবার বড় যুদ্ধ না করেও প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত রাখতে পারে। কিন্তু ইউরোপ যদি শক্ত বার্তা না দেয়, তবে এটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হবে। তখন আকাশসীমার নিরাপত্তা এক ধরনের আপসকৃত বাস্তবতায় পরিণত হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
শেষ পর্যন্ত, পোল্যান্ডের আকাশে এই ড্রোন অনুপ্রবেশ একটি সতর্ক সংকেত। এটি দেখিয়ে দিল যে ইউক্রেন যুদ্ধ ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেকোনো মুহূর্তে ইউরোপীয় মাটিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইউরোপ যদি এখন থেকেই ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ় ও কৌশলগতভাবে সচেতন পদক্ষেপ না নেয়, তবে আগামী দিনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। আর রাশিয়ার জন্যও এটি এক প্রকার দ্বি-মুখী তলোয়ার। তারা হয়তো সাময়িকভাবে কিছু কৌশলগত সুবিধা নিচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি ইউরোপকে আরও একীভূত করে তুলতে পারে এবং রাশিয়াকেই একঘরে করতে পারে।
এখন ইউরোপীয় নেতৃত্বের সামনে প্রশ্ন—তারা কি কেবল প্রতীকী প্রতিক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি সত্যিকার অর্থে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ করবে? আকাশসীমার ভাঙন কেবল একটি সামরিক ঘটনা নয়, এটি ভবিষ্যতের ভূরাজনীতির ইঙ্গিত। সেই ভবিষ্যৎ হবে সংঘাতময় না নিরাপদ, তা নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের ওপর।
Comments